প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। যশোর রেল স্টেশনে আসতে গিয়ে অনিক ভিজে গেছে। স্টেশনের প্লাটফর্মে মানুষের ভিড়ে গিজগিজ করছে। অনিক কাঁধ হতে ব্যাগ নামিয়ে তয়ালে বের করে মাথাটা ভাল করে মুছে নিল। পকেট হতে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরাল। দূরে দুটো ছোট ছেলে বৃষ্টির পানি নিয়ে খেলা করছে।অনিকের প্যান্ট ধরে টান দিল। অনিক নিচে তাকিয়ে দেখে ছোট একটা শিশু।অনিক ভাবে বাহ! ভারি সুন্দর তো বাচ্চাটা। অনিক নিচু হয়ে দু’হাত দিয়ে বাচ্চাটিকে ধরে বলল কি নাম তোমার? কাকে খুজছো? তোমার আব্বু কে? বাচ্চাটি কোন কথা বলে না শুধু অনিকের দিকে তাকিয়ে থাকে অবাক দৃষ্টিতে। তুমি কি আমাকে চেনো? বাচ্চাটি মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলে।অনিক অবাক হয়ে বলে কিভাবে? তুমি কি আমাকে এর আগে দেখেছো? আগের মত মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলে। কোথায় দেখেছো আমাকে? এবার বাচ্চাটি কথা বলে আমাদের ঘরে আপনার ছবি আছে আর আপনি আমার আঙ্কেল হন। অনিক কিছুতেই বুজে উটতে পারছে না যে কিভাবে তার ছবি এই বাচ্চার বাড়িতে।তোমার আব্বু কে? সাজিন আহমেদ।কি তুমি সাজিনের ছেলে।অনিকের বুকের ভেতরে একটা উত্তেজনা কাজ করতে লাগল। ছোট বাচ্চাটিকে জড়িয়ে ধরে কপালে মুখে চুমু খেতে লাগল যেন হীরের টুকরো হাতে পেয়েছে।অনিক বলে তোমার নাম কি? আমার নাম অনিক।তাহলে সাজিন এখনও আমাকে আগের মত বন্ধু ভাবে ভালবাসে। এরপর অনিক ভাবনায় দুবে যায়।
সাজিন ও অনিক ছিল জিগ্রি দোস্ত। একে অন্যের ছাড়া কখনই থাকতে পারতো না। লোকে এই দু’জনকে মানিক রতন বলে ডাকতো। যেখানে সাজিন সেখানেই অনিক আর যেখানে অনিক সেখানে সাজিন।
অনিক সব সময় সাজিনের বাড়ি পড়ে থাকে।সাজিনের মাকে মা বলে ডাকতো।সাজিনের মায়ের রান্না না খেলে অনিকের পেটের ভাত হজম হত না।সাজিনের বাড়ি প্রায়ই চুরি হয় তা আবার যেন তেন জিনিস নয়। মায়ের হাতে রান্না করা পায়েস। মা সব সময় সাজিনের দোষ দেয়।বলে আমার অনিকের জন্য এত স্বাদ করে পায়েস রাঁধি।আর তুই সব খেয়ে ফেলিস।অনিক আহ্লাদী করে মা আঁচল ধরে বলে মা…।পায়েস খাব।এখনি রান্না করে দিচ্ছি বাবা…তুই বস। সাজিন বলে আমি আর মা ছাড়া এই বাড়িতে কেউ থাকেনা কিন্তু খাই কে? অনিক বলল কেন আমি থাকি না বুঝি। মানে ! মানে আমিই চুরি করে খাই আর দোষ হয় তোর।সাজিন রেগে বলে তবেরে শালা ……অনিক দৌড়ে মায়ের আঁচলের নিচে লুকায়।দেখনা মা সাজিন আমাকে মারছে। এই মারছিস কেন আমার পাগল ছেলেকে।মা যানো… সাজিন বলার আগে অনিক বলে তুমি আমাকে বেশি ভালোবাসো তাই ওর সহ্য হচ্ছে না। মা বলে তাই বুঝি। ঠিক আছে এর জবাব পরে দেবো সাজিন বলে। অনিক বলে তাই…মাকে বলি…মা দেখো সাজিন আমাকে…।
অনিক সাজিনের দিন কাল ভালই যাচ্ছিল। কিন্তু একদিন কলেজে একটি নতুন মেয়ে ভর্তি হল। প্রথম দেখাতে সাজিন মেয়েটিকে ভালোবেসে ফেলে।সাজিনের এখন একটাই চিন্তা কিভাবে ঐ মেয়ের সাথে কথা বলবে তারপর প্রেম করবে।
মেয়েটির নাম রিয়া।দেখতে খুব সুন্দরী। রিয়ার বাবা সরকারি চাকরি করে।সরকারি চাকরির কারনে রিয়া আজ এখনে তো আগামী বছর অন্যখানে ।সেই সুবাদে রিয়া সিটি কলেজে ২ বর্ষে ভর্তি হয়েছে। রিয়া অনেক বুদ্ধিমতী মেয়ে।ক্লাসের প্রথম দিনেই সাজিন রিয়াকে বলে হাই!আমি সাজিন ও আমার বন্ধু অনিক। তুমি? আমি রিয়া।সাজিন হাত বারিয়ে বলে ফ্রেন্ডস।রিয়া বলল এত তাড়াতাড়ি। আগে দেখি তোমরা কেমন তারপর ভেবে দেখবো।
সাজিন এখন যদি ১০০ টা কথা বলে তার মধ্যে ৯৯ টা কথাই থাকে রিয়াকে নিয়ে। রিয়া আমাকে পছন্দ করবে কি না…আমাকে ভালোবাসবে কি না… ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিছুদিনের মধ্যে রিয়া সাজিনের ভালো ভাব হল আর এরপর যা হবার তাই হল। সহজ কথায় যাকে বলে প্রেম বা ভালোবাসা। রিয়া সাজিন গল্প করে আর অনিক দূরে বসে বসে বাদাম খাই।সাজিনের পুরো হৃদয় জুড়ে এখন রিয়া আর রিয়া।সেখানে অনিকের জায়গা নেই বললেই চলে। সাজিন রিয়া যেখানেই যাক না কেন সঙ্গে অনিক থাকা চাই।
ধীরে ধীরে অনিকের দূরত্ব বারতে থাকে। সাজিন এখন অনিকের সাথে আগের মত কথা শেয়ার করে না। বরঞ্চ এখন পারলে কথা লুকায়।আগে কোথায় কি করছে কি খাচ্ছে সব সব জানাত। এখন রিয়া সম্পর্কে ভালো বা খারাপ কথাও বলা যাই না। এতে সাজিন রাগ করে।
অনেক দিন হল দুই বন্ধু একসাথে নিরিবিলি বসে কথা বলতে পারে না।যদিও পারে ঠিক সে সময় রিয়ার ফোন এসে হাজির হয়।সাজিন ফোন রিসিভ করে দূরে গিয়ে কথা বলে আর অনিক নির্বাক হয়ে বসে থাকে।
আজ অনিকের জন্মদিন কিন্তু কেঊ তাকে জন্মদিনের উইশ করে নি।এমন কি বন্ধু সাজিনও না। একবুক কষ্ট নিয়ে সাজিনের বাড়ি যাচ্ছে অনিক।অনিক যানে মা তার জন্য পায়েস রান্না করে বসে আছে। কয়েকবার মনে হয়েছিল যাবে না কিন্তু মা কষ্ট পাবে তাই বাধ্য হয়ে তাকে যেতে হচ্ছে।
ফুটপাত দিয়ে আনমনে হেটে যাচ্ছিলো অনিক। আচমকা দাড়িয়ে পড়ল।অনিক নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এ আমি কি দেখলাম রিয়ার সাথে অন্য কেউ।অনিক রিয়াকে অন্য একটি ছেলের সাথে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখেছে।অনিক নিজেকে সংযত রাখতে পারল না।রিয়ার কাছে গিয়ে বলল রিয়া!অনিক কে দেখে রিয়া ভয় পেয়ে গেল।বুঝতে পারছে না কি করবে।রিয়া উঠে দাঁড়ালে অনিক টেনে একটা চর মারে।আমার বন্ধুকে নিয়ে এভাবে খেলা করছিস। ও তোর কি ক্ষতি করেছে বল।আজকের পর থেকে সাজিনের ধারের কাছে তোকে যেন না দেখি।কথাটা যেন মনে থাকে।অনিক আর দাঁড়াল না সোজা সাজিনের কাছে চলে গেল।
অনিক রিয়ার ব্যাপার টা এখন জানাতে চাইছে না। কারন এতে কষ্ট পাবে।আন্য সময় বুঝিয়ে বলবে। সাজিনকে কাছে পেয়ে অনিক জড়িয়ে ধরল। সাজিন বলল রিয়ার গাই হাত তুলেছিস কেন?বন্ধু আজ না অন্য এক দিন বলব। কিন্তু সাজিন মানতে চাইছে না।তোকে এখনি বলতে হবে। কেন মারছিস…কেন?কেন? অনিক বলল আমি আজ বলতে পারব না। সাজিন রেগে অনিকের গালে একটা চর মারে। কেন পারবি না?তোকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম। তার এই প্রতিদান দিলি।অনিক বলে ও রিয়া তোকে কিছু বলেছে। তুই আমাকে ভুল বুঝছিস বন্ধু।রিয়া তোকে…সাজিন অনিকের কথা থামিয়ে বলে একটা ও বাজে কথা বলবি না রিয়াকে নিয়ে। রিয়া আমাকে সব বলেছে। তুই ওকে খারাপ প্রস্তাব দিয়েছিলি।ও রাজী হয়নি বলে তুই ওর গাই হাত তুলেছিস। অনিক বলল সব মিথ্যা রিয়া তোকে ঠকাচ্ছে। চুপ একদম চুপ আর একটা বাজে কথা বললে তোকে আমি তোকে খুন করব। সামান্য একটা মেয়ের জন্য তোর বন্ধুকে খুন করবি। বাহ! বন্ধু বাহ! দুই দিনের পরিচয়ে আমার থেকে ও তোর কাছে বেশি বিশ্বাসী হয়ে গেল। সাজিন বলে তুই আমার চোখের সামনে থেকে চলে যা আর কখনো আমার সামনে আসবি না। অনিক আর কথা বলে না। এক বুক জ্বালা নিয়ে সাজিনের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় অনিক বলে বন্ধু আজ আমার জন্ম দিন।
অনিক আজ এক বিরাট প্রশ্নের সম্মুখীন। কি করে এত দিনের বন্ধুত্বের বন্ধন এক নারীর কারনে নিমেষেই ছিন্ন হয়।আজ রিয়ায় সব। তার প্রতিটি কথায় সত্য আর বাকি সবার কথা মিথ্যা মনে হয়।বন্ধু থেকে স্ত্রী আপন হবে এটাই স্বাভাবিক।কারন তাকে নিয়ে সে সারাজিবন সংসার কাটাবে। তবে কোন সম্পর্ক চির স্থায়ি নয়। কারন মানুষ বন্ধনে জড়ায় বন্ধনকে ছিন্ন করার জন্য।
অনিকের ঘাড়ে সাজিন হাত রাখলে পিছনে ফিরে দেখে সাজিন।অনিক অবাক দৃষ্টিতে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়।কিন্তু কোন কথা বলতে পারে না।কিছুক্ষন কেউ কারও সাথে কথা বলতে পারল না।দুজনেই স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছে।চোখে পানি মুখ বেয়ে নিচে পড়ছে।সাজিন অনিককে বুকে টেনে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে এতদিন কোথায় ছিলি তুই? তোকে কত খুঁজেছি।অনিক কোন কথা বলতে পারে না।শুধু একটা কথা বলে মা কেমন আছে?
দুজনের মধ্যে অনেক কথা হল কিন্তু অনিক একবারও রিয়ার কথা জিজ্ঞাসা করল না।অনিক বলল কোথায় যাবি। কোথাও না অনিকের মা আসবে এই ট্টেনে। রিয়া ভেবে অনিকের মন খারাপ হয়ে গেল।মন চাইছে না রিয়ার সাথে দেখা করার জন্য।এর মাঝে ট্টেন এসে থামল।সাজিনের ছেলে ওর মাকে দেখে বলে আব্বু ঐ যে আম্মু।অনিক রিয়ার কথা ভেবে মাথা নিচু করে আছে।সাজিনের স্ত্রী অনিককে বলে কেমন আছেন অনিক ভাই। অনিক বলল ভাল! মাথা উচু করে সাজিনের স্ত্রীকে দেখে অনিক অবাক হয়। সাজিন বলে অবাক হচ্ছিস রিয়া না হয়ে এ কেন। সে অনেক কথা পরে বলব।আগে বাসায় চল। অনিক বলে বন্ধু আজকে না অন্যদিন আমার কাজ আছে।আমাকে এই ট্টেনে যেতে হবে।অনিক চলে আসবার আগে ছোট অনিকের মাথায় চুমু দিয়ে বলে থ্যাং ইউ আঙ্কেল তোমার কারনে আমার বন্ধুকে ফিরে পেলাম…………।
‘‘সমাপ্ত’’
Post a Comment
Post a Comment