অভিমানী ভালবাসা

         অভিমানী ভালবাসা

সিলেট যাবার টান টান উত্তেজনাতে সারা রাত ঘুম হয়নি। অবশ্য আমার ঘুম হয়না এ আর নতুন কিছুনা। প্রতিটি রাত্রি আমার জন্য নির্ঘুম এক বার্তা নিয়ে আসে যা আমাকে ঘুমাতে দেয়না। আজ শুক্রবার পহেলা ডিসেম্বর রাত ৯.৫০ মিনিটি ছেড়ে যাবে ঢাকা থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনটি। এই ট্রেনটি আমাকে নিয়ে যাবে মৌলভীবাজার জেলাতে। যেখানে আমার ভালোবাসার মানুষটির বসবাস। ভোর ৫ টা থেকেই যাওয়ার পরিকল্পনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। শীতের সকাল কিন্তু ঢাকাতে তেমন শীতের আবির্ভাব নেই। কখনো সিলেট যাওয়া হয়নি তাই সেখানকার মানুষ সেখানকার আবহাওয়া সম্পর্কে একদম অজ্ঞ বটে। পরেরদিনই ফিরে আসবো তাই রিটার্ণ টিকেট নিতেও ভুল করেনি। ভোর বেলাতে গোসল করতে বড্ড বিরক্তি এক ভাব আসে তারপরেও গোসল করে ৭ টার মধ্যে ফার্মগেট হোস্টেল থেকে বের হয়ে পড়লাম। সাথে একটি ব্যাগ তার মধ্যে রয়েছে আমার প্রেয়সীর জন্য কিছু উপহার, যা আমার জীবনের অতিমুল্যবান জিনিস। আজ পর্যন্ত কেউ জানে না আমার এই ব্যাগে আমি কি নিয়ে ঘুরতাম, বা কাউকে কেন এই ব্যাগ ধরতে দিতাম না। সেই উপহার গুলোই প্রেয়সীকে দেবার আকাঙ্ক্ষা মনেতে চেপে বসেছে। মানুষ যাকে ভালোবাসে তার কাছে কিইবা লুকানোর আছে এই কথাটির উপর ভিত্তি করেই ব্যাগ গুছিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে পড়লাম।

ট্রেন তো রাতে আর আমি বের হয়েছি ভোর সকালে, কোথায় যাবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম আজ আমার পছন্দের জায়গাগুলোতে ঘুরে সময় পাড় করে দিবো। প্রথমে ধানমন্ডি ৩২ লেক এ চলে গেলাম। পুরো লেক বিনা বিরতিতে ঘুরে বেড়ালাম, আর কিছু কবিতা লিখলাম। সময়টা কাটছিলো না তারপরেও অনেক সময় ব্যায় করে ঘড়ির কাটায় ১০ টা বাজালাম। তিন ঘন্টা অতিক্রম করতেও যেন আমাত তিন যুগ লেগে গেলো। আচ্ছা মানুষ কাউকে ভালোবাসলে তার জন্য এত ছটফট কেন করে, এই অস্থিরতা কি ভালোবাসা। হয়ত তাই হবে। ধানমডি থেকে ৭ নম্বর বাস এ চড়ে গেলাম রমনা পার্কে। সেখানেও সময় কাটাতে বড্ড কষ্ট হয়েছে। যেমন তেমন করে ঘড়িতে এখন ঠিক ৩ টা বেজেছে। এরই মধ্যে উদয়ের ফোন, সে রয়েছে প্রেসক্লাবে আমাকে তার সাথে দেখা করতে বললো। যেহেতু কাছেই ছিলাম তাই উদয়ের সাথে দেখা করতে চলে গেলাম। তার সাথে ঘন্টাখানেক কাটিয়ে চলে গেলাম কমলাপুর ষ্টেশনে। যেখানে আমার অপেক্ষায় রয়েছে ৭৩৯ নম্বর এর উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনটি।

কিউবি ইন্টারনেট এর বাৎসরিক উদযাপন উপলক্ষে রেল জংশনে রয়েছে ফ্রি ওয়াইফাই এর ব্যবস্থা। সেই সুযোগটাও কাজে লাগাতে আমজ ভুল করিনি। ওয়াইফাই পেয়ে কোথায় নামতে হবে কোন গাড়িতে উঠতে হবে কোথায় আমার প্রেয়সীর কর্মস্থল সব খুজে বের করে স্ক্রিনশট নিয়ে নিলাম। ইতিমধ্যে রাত হয়ে আসছে উত্তেজনাতে ক্ষুদার কোন ভাব ভংগি পেলাম না, তারপরেও বাহির থেকে বট আর পরোটা খেয়ে নিলাম। সাথে রাতে যেন আবার জ্বর না উঠে তাই ওষুধ টাও খেলাম। ৬ নম্বর প্লাটফর্ম এ সিলেট যাবার ট্রেনটি অপেক্ষারত আছে। ট্রেনের কাছে গিয়ে কোচ নম্বর-ঝ সিট নম্বর -৩৯ খুজে বের করে সেখানে বসে রইলাম। ট্রেন ছাড়তে এখনো ত্রিশ মিনিটের মত সময় রয়েছে এই ফাকে একটা সিগারেটকে ছাই করতে লাগলাম আর সাথে কলিজাকে।

শিখা আমার সাথে কথা বলেনা গত এক মাস আগ থেকে, সে কোনভাবেই আমার সাথে দেখা করবে না, তর্কাতর্কি তে আমাকে ফেসবুকে ব্লক করেও রেখেছে। আমি শতবার ফোন দিলেও অপর প্রান্ত থেকে শুধু একটি কথাই ভেসে আসে "আপনার ডায়ালকৃত নাম্বার টি এই মুহুর্তে ব্যস্ত আছে, কিছুক্ষন পর আবার ডায়াল করুন" এই কথাটি বলার কারন আমি যতবার তাকে ফোন দিয়েছি সে ততবার কেটে দিয়েছে। ম্যাসেজের পর ম্যাসেজ তার ইনবক্স এ জমা হচ্ছে কিন্তু তার নাম্বার থেকে একটি ম্যাসেজ আমার কপালে জুটে না। যখন ট্রেন ছেড়ে দিলো, তখন মনে হলে ইশ আমি তো কোন গরম কাপড় সাথে নেইনি। ওখানে শীত কেমন তা জানা নেই, তাছাড়া আমার রয়েছে রাত্রী জ্বরের রোগ। মুহুর্তেই সেই কথা ভুলে গেলাম, যখন মনে পড়লো আরে আমি তো সিলেট যাচ্ছি, মুহুর্তেই আগের উত্তেজনা ফিরে আসলো।

আমি প্রতিটা ষ্টেশনে পৌছে তাকে ম্যাসেজ দিয়ে জানাচ্ছি, বার বার কল দিয়ে যাচ্ছি এক পর্যায় রাত যখন ১ টা বেজে ৪০ মিনিট তখন সে তার সব নাম্বার অফ করে দেয়। আমি তখন ভৈরব ষ্টেশন অতিক্রম করতেছিলাম। ধীরে ধীরে শীতের আবির্ভাব হতে লাগলো, ট্রেনের ছুটে চলার দমকা বাতাসের সাথে শো শোঁ করে ঢুকছে কুয়াশা। তখন থেকেই আমার হাত পা কাপুনি শুরু হয়েছে, তা আর থামেনি, আমি ক্ষনে ক্ষনে কেপে উঠছি আর শিখাকে ফোন দিয়ে যাচ্ছি তার ফোন সুইচ অফ। ভোর ৪ টা বাজে আমি শ্রীমঙ্গল ষ্টেশনে নেমে পড়লাম, চারিদিকে শুধু কুয়াশা আর কুয়াশা, এক হাত সামনে কি রয়েছে তা বোঝা মুশকিল। কিছুক্ষণ পর পর ধেয়ে আসছে হিমশীতল বাতাস, যে বাতাস আমার রুহ পর্যন্ত কাপিয়ে তুলছিলো। পুরো ষ্টেশন ফাকা যেন কোন অবৈধ জায়গায় চলে এসেছি দু একটা দোকান ছিলো সেগুলোর লোকগুলোও ভিতরে শীতের ভয়ে ঘুপটি মেরে বসে রয়েছে। কুয়াশার মধ্যে আমি কোন দিকে হেটে যাচ্ছি তা আমি বুঝতেও পারছিলাম না। যখন ষ্টেশন থেকে বের হলাম, সামনে দু একটা সি.এন.জি দেখতে পেলাম। যারা মৌলভীবাজার এ যাওয়ার জন্যই বসে আছে। আমি ছাড়া আরো অনেক যাত্রী ছিলো যারা ভাড়া বেশীর কথা শুনে আর এত রাত্রে গেলে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়তে হতে পারে ভেবে তারা যেতে রাজী হলোনা। পরবর্তীতে আমি ২৭০ টাকা ভাড়া মিটিয়ে সি.এন.জি রিজার্ভ নিয়ে মৌলভীবাজার এর যাত্রা শুরু করলাম।

প্রায় ৪০ মিনিট এর সি.এন.জি এর যাত্রাকালে আমি যা উপভোগ করেছি তা শুধু আমার শরীরের প্রতিটি অংগ পতঙ্গ বরফ হয়ে যাচ্ছিলো, আর রক্তকণিকা শিশির বিন্দুতে পরিনত হচ্ছিলো। যখন আমি মৌলভীবাজার এসে পৌছালাম, সি.এন.জি থেকে নেমে গাড়ির ভাড়া দিচ্ছিলাম, তখন আমার হাত শরীর থর থর করে শুধু কাপছিলো, আমি প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম অবস্থা। তখন ড্রাইভার নেমে তার গায়ের শাল টা আমাকে পড়িয়ে দিলেন, আর কিছু কাগজ জোগার করে আগুন জালালেন, তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমার এ অবস্থা কেন, আমি কেন শীতের কোন কাপড় আনিনি, তাকে সংক্ষেপে উত্তর দিলাম, আমি এখানে একটি কাজে এসেছি ঢাকাতে শীত ছিলোনা তাই ভেবেছিলাম এদিকেও এমনি হবে। কথা না বাড়িয়ে আমি আগুন পোহাতে লাগলাম এখন যেন একটু প্রান ফিরে পেয়েছে দেহ, তারপর লোকটির কথা ভাবতে লাগলাম বড্ড ভালো মানুষ না হলে এমন টা কেউ করবে না। তখন মনে হয়েছে আসলেই সিলেটের মানুষ অনেক ভালো।

কিছুক্ষন পর লোকটি তার শাল আমাকে দিয়ে চলে যেতে চাইলো, ষ্টেশন থেকে আরো যাত্রী আনতে হবে তার। আমি তাকে ৫০০ টাকা দিয়ে দিলাম, সে অতি তৃপ্তিকর একটি হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কি কাজে আসছেন?
তেমন কোন কাজ না, একটি স্বপ্নের খোজে এসেছি।
০- আপনার কথা কম বুঝতে পারতেছি, কিন্তু কিছু বুঝতে পারছি। যাইহোক সাবধানে থাকবেন আমি আসি। কথাটি বলে লোকটি সি.এন.জি চালু করে চলে যেতে লাগলো, আমি শাল উড়ো দিয়ে আগুন পোহাতে লাগলাম, আর ভোর হবার অপেক্ষা করতে লাগলাম।


যখন কুয়াশাতে চারদিক ঘিরে রয়েছে আমি সেই কুয়াশার ভেতর ডুবে গেলাম আমাত অতিত স্মৃতি নিয়ে। বেশ মজাদার ছিলো অতিত স্মৃতি সাথে ছিলো ধারালো কোন অস্ত্রের আঘাতের ক্ষত। শিখা আমার জীবনে আসে ফেসবুকের কল্যাণে, আমার লেখা গল্প কবিতা তার ভালো লাগতো। আমার স্বভাব অনুযায়ী আমি কখনো কাউকে ম্যাসেজ দিতাম না। ফেসবুকে খুব কম আসার কারনে কেউ ম্যাসেজ দিলেও তার রিপ্লে ২-৩ দিন পর দিতাম। অনেক ম্যাসেজের ভিড়ের মাঝে শিখার ম্যাসেজ ছিলো, প্রথমদিন তার সাথে যত ম্যাসেজিং হয়েছিলো আমার ফেসবুক জীবনে এত ম্যাসেজ কখনো হয়নি কারো সাথে। ধীরে ধীরে কথার গতি বাড়তে লাগলো, এক সময় মোবাইল পর্যন্ত পৌছে গেলো, আর আমার অপরিকল্পিত জীবনের সাথে কাউকে জড়াতে না চেয়েও জড়িয়ে ফেললাম এমন ভাবে যে ছুটে আসার কোন রাস্তা খোলা ছিলোনা। মনপাখি বন্ধি হয়েছে তার কাছে। এখন আর এ মন আমার নেই মনটার উপর পুরো শক্তি চলে শিখার।

শিখার ভালোবাসা পেয়ে আমি যেন আমার জীবনের মানে খুজে পেয়েছিলাম। নতুন করে বাচতে শিখেছিলাম, আমি যখন আমার জীবন নিয়ে অতিষ্ট সেই সময়টা শিখা আমাকে দেখিয়েছে নতুন ভাবে বেচে থাকার স্বপ্ন। যে স্বপ্নের খোজে আমি এতকাল ছিলাম সেই স্বপ্নকে কোনভাবেই হারাতে চাইনি। কথায় আছে না, যা হারাতে চাইবে না তাই তোমার থেকে হারিয়ে যেতে চাইবে বার বার বারংবার। আমার সুখের সময় রেখা বেশীদিন ছিলোনা, অল্প সময়তেই সুখের ঘরে ফাটল ধরতে লাগলো। শিখা কে যেন কখনো হারিয়ে না ফেলি এই ভয় এতটাই আমাকে গ্রাস করেছিলো, যার কারনে প্রয়োজনের থেকে বেশী শক্ত হয়ে গিয়েছিলাম আমিমি। আসলে না পুরন হবার স্বপ্ন যখন পুরন হতে চলে তখন মানুষ বেকাবু হয়ে পড়ে। আমার বেলাতেও তাই হয়েছে। কোনভাবেই শিখাকে আমি কারো সাথে কথা বলতে দিতে চাইতাম না, যদি হয় ছেলে তবে মোটেও না। এই অতিরিক্ত ভয়টাই আমার সুখকে মেরে ফেলেছে, ধীরে ধীরে সন্দেহ কাজ করতে লাগলো, তার অতিরিক্ত ফেসবুকে আর ইমুতে থাকার কারনে। এই নিয়েই ঝগড়ার সুত্রপাত।

এক পর্যায় ঝগড়ার মাত্রা অনেক বেড়ে গেলে তাকে গালিগালাজ করি, সেখান থেকে সব কিছুই যেন এলোমেলো হয়ে গেলো। সে পালটে গেলো হুট করেই কোন রকম সতর্কবার্তা না দিয়ে। সে পালটে যাবার পর আমার জীবন আবার নরক হয়ে গেলো। গত এক মাস ধরে যখন তাকে মানাতে পারছিলাম না, তাই সিদ্ধান্ত নিলাম সিলেট গিয়েই তাকে মানাবো। কিন্তু ঘটনা এটা ছিলোনা আমাকে ছেড়ে যাবার পেছনে, ঘটনা তার পরিবার। শিখা বাবা মায়ের বড় আদরের মেয়ে, শিখা তাদের মনে কখনো কষ্ট দিতে পারবে না। সে আগে থেকেই কথাটি বলতো আমাকে, সেটাই বাস্তব হবে তা জানা ছিলোনা। তার পরিবারের কথা ভেবে আর আমার বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করেছে যে কষ্ট আমি ভবিষ্যৎ এ পেতাম সেটা এখনি অল্পতে সয়ে যেতে হবে। মাঝখানে আমার আর্থিক অবস্থাও চরম খারাপ ছিলো, তখন সে দুই দফায় আমাকে ১৫০০ টাকা দিয়ে সাহায্য করেছে। সেই ঋনটাও শোধ হবার নয়।

শিখা যখন নিজের মুখে জানালো তার এনগেইজড হয়ে গেছে, এবং একই কথা যখন সে আমার দুলাভাইকে জানালো আমার মস্তিষ্ক যেন পুরো ফাকা হয়ে গেলো। এত সহজে কি আর স্বপ্ন কে হারিয়ে যেতে দেওয়া যায়। তাই শেষ চেষ্টা করতেই আমার মৌলভীবাজার আসা।


ফজরের আযান দিচ্ছে আমি এখনো কাগজ কুড়িয়ে আগুন পোহাচ্ছি। ধীরে ধীরে অন্ধকার মৌলভীবাজার আলোকিত হতে শুরু করলো। তখনো এই জনবহুল স্থানটি জনশুন্য। দূর দূর পর্যন্ত কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আমি শিখার বন্ধ মোবাইলেই ম্যাসেজ করে যাচ্ছি, যদি হঠাৎ সে মোবাইল অন করে তবে কল না যাক আমার ম্যাসেজ তো পাবে। সকাল ৭ টার মধ্যে পুরো মৌলভীবাজার আলোকিত হয়ে নতুন সুর্যের কিরন ঝকঝক করছে। কিছু মানুষ আর গাড়ির আনাগোনা শুরু হয়েছে। পাশেই একটি চায়ের দোকান খুলতেছে, আমি সেখানে গিয়ে চায়ের আশায় দাঁড়িয়ে রইলাম, প্রায় ত্রিশ মিনিট পর চা হাতে আসলো। চায়ে চুমুক দিতেই যেন প্রান ফিরে পেলাম নতুন করে। চা শেষ করে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম, শমশের নগর রোড, চৌমোহনা, মৌলভীবাজার এর মধ্যে গাজী ভবন কোথায়? দোকানদার কিছুক্ষন ভাবলো, তারপর আমাকে ঠিকঠক জায়গাটা চিনিয়ে দিলো।

গাজী ভবন, যেটা নির্মান করেছিলেন গাজীউর রহমান। সেই ভবনের দ্বিতীয় তলায় রয়েছে প্রাইম ইসলামী ইন্সুরেন্স কোম্পানী যেখানে শিখা চাকুরী করে। ঠিকানাটা আমি অনলাইন ঘেটেই নিয়েছিলাম, আর শিখা জানিয়েছিলো অফিস থেকে তার বাসা মাত্র পাচ মিনিটের পথ। আমার কাছে তথ্য এটুকুই ছিলো তাকে খোজ করার। আর আমি শিখাকে জানিয়েছিলাম আমি অফিসের সামনে থাকবো, তার অপেক্ষায়। গাজী ভবনের নিচ তলায় রয়েছে হাতিল ফার্ণিচার এর শোরুম, উপরের তলায় শিখার অফিস, তিন তলায় কৃষি ব্যাংক। তার পাশেই রয়েছে এস.আই.বি.এল ব্যাংক লিঃ। গাজী ভবনের ঠিক সামনে রয়েছে একটি চায়ের দোকান। আমি গাজী ভবনের দিকে তাকিয়ে চায়ের দোকানে ঢুকলাম এবং ভাবতে লাগলাম, শিখা বলেছিলো তার বাসা বাজারের মধ্য দিয়ে খানিকটা পথ হেটে গেলেই তার বাসা। অনেক হিসেব করে বের করলাম করলাম রাস্তার মোড় ধরলে ডানদিকে বাসট্যান্ড, বাম দিকে সিলেট মহাসড়ক, পেছনের দিকে শমসের নগর তাহলে এই তিন রাস্তা নয় তার বাসা এই রাস্তাতেই হবে। আমি যে রাস্তায় প্রবেশ করছিলাম তার বাসা খোজ করার জন্য সে রাস্তার নাম এম.সাইফুর রহমান সড়ক।

আমি আবার পেছনে আসলাম তার অফিসের সামনে, সেখান থেকে মোবাইল স্টপ ওয়াচ এর সাহায্যে কাউন্টডাউন শুরু করলাম। এবং ঠিক পাচ মিনিট হেটে যাবার পর আমার সামনে একটি মন্দির পড়ে, তার পাশে অনেক গুলো দুতলা তিনতলা বিশিষ্ট্য পুরাতন আমলের বাসা। তখন আমার মাথায় শিখার পাঠানো কিছু ছবির দৃশ্য খেলে যায়, শিখা নীল শাড়ি পড়ে ছাদ থেকে কিছু ছবি আমাকে তুলে দিয়েছিলো। যেখানে ছাদ অনেক পুরানো ছিলো, এবং রেলিং এ শেওলা জর্জরিত ছিলো। আশে পাশের বিল্ডিং গুলোর সাথেও মিলানোর চেষ্টা করলাম, অনেক টা মিলাতে সক্ষম হচ্ছিলো। শিখার সব ছবি আমি ডিলেট করে দিয়েছিলাম কারন সে বলেছিলো, আমি নাকি তার ছবি নিয়ে তাকে ব্লাকমেইল করবো। সেদিনই সমস্ত ছবি ডিলেট করে দিয়েছি, যতটুকু আছে আমার মস্তিষ্কে। তাই থেকেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম বাসা খোজার।

আমি ঘুরে ফিরে শুধু মন্দির আর সেই বাসা গুলোই ঘাটছিলাম, এখনো কুয়াশা সম্পুর্ণ কাটেনি। খানিক দুরের অবস্থান বোঝা মুশকিল। আর আমার চোখটাও এখন ঘোলা হয়ে গেছে চোখ বড় করে শুধু ঘুরে যাচ্ছি এক অনিশ্চিত সত্যের সন্ধানে

তখন সময় সাড়ে আট কিংবা নয়টা বাজে। আমি মন্দিরের আশেপাশেই ঘুরতেছি, একটু সামনে আসতেই লক্ষ্য করলাম তিনতলার বাড়িটিতে একটি মেয়ে লাল জামা পড়া অবস্থায় দাঁড়িয়ে দাত ব্রাশ করছিলো। আমি দ্রুত পায়ে হাটতে লাগলাম, বাড়িটির কাছাকাছি এসে আমি চোখ বড় করে মেয়েটির দিকে তাকালাম, হালকা কুয়াশা আর আমার সারা রাতের শীতের ঝাকুনী দুটি মিলিয়ে দৃষ্টিশক্তি বেশ লোপ পেয়েছে, আমি ধীর পায়ে চলতে লাগলাম আরর দেখতে লাগলাম, আমি তার কুয়াশাচ্ছন্ন চেহারাটা আমার মস্তিষ্কে আকা শিখার ছবির সাথে মিলাতে লাগলাম। এরই মধ্যে মেয়েটি আমার দিকে তাকালো, আমি তখন আরো ভালো করে মিলাতে চাইলাম, কিন্তু সে সুযোগ আমি আর পাইনি। এরই মধ্যে সে ভেতরে চলে গেলো, কিন্তু যতটুকু মিলাতে সক্ষম হয়েছি আমার ক্লান্ত দুটো চোখ দিয়ে, তাতে আমি বলতে পারি সেটা শিখা ছিলো কিন্তু ৫০%। আর এক মিনিট যদি সময় পেতাম তাহলে ১০০% বলতে পারতাম, তা পারছিনা কারন আমি বড্ড ক্লান্ত শীতের তরল আঘাতে চোখে ঝাপসা ছাড়া স্পষ্ট কিছুই দেখিনা।

তারপর থেকে একবার শিখার অফিস একবার সেই পুরোনো বাড়ির চক্কর কাটতে লাগলাম, আরর বিরতিহীন ভাবে তাকে ম্যাসেজ কল দিতে লাগলাম, তার মোবাইল বন্ধ আমার পাঠানো ম্যাসেজ গুলোও তার মোবাইল এ ডেলিভারি হচ্ছে না। সকাল থেকে দুপুর গড়ালো, এর মধ্যে একবার সে মোবাইল অন করেছিলো, আমার কল দেখে আবার অফ করে দিলো। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম, অফিসের সামনে এক নাগারে বিকেল হয়ে আসলো। কিন্তু শিখা মোবাইল না অন করলো, না সে অফিসে আসলো, নাইবা সেই মেয়েটিকে ছাদে আরেকবার দেখতে পেলাম। যদি একই চেহারার মানুষ পৃথিবীতে সাতজন হয়ে থাকে, তবে দুজন একই শহরে থাকতে পারেনা, আর শিখার কোন জমজ বোন তো ছিলোনা । তাই অনেকটা আত্মবিশ্বাস এর সাথেই বলতে পারি যে মেয়েকে ছাদে দেখেছি অর্ধ কুয়াশার মাঝে সে শিখাই হবে। কারন সব কিছুই শিখার নিজ মুখে বলা ছিলো, তার বাসা, তার অফিস, আর বাজারের সম্পুর্ন কথাবার্তা আমার স্পষ্ট মনে আছে। সব কিছুর হিসাব মেলালে সেটা শিখার বাসা না হয়ে যায়না।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলো, ধীরে ধীরে শিখা আসবে আমার সামনে সেই আত্মবিশ্বাস ভেংগে যেতে লাগলো। মাগরিব নামাজ পর্যন্ত আমি সেখানেই সেই রোডেই, সেই অফিসের সামনেই দাঁড়িয়ে রইলাম, এই হয়ত শিখা আসবে বলে। কিন্তু সে আসেনি। এর মাঝে একবার মৌলভীবাজার সরকারী কলেজেও গিয়েছিলাম সেখানে শিখা পড়ে, কিন্তু সেই চেষ্টাও বিফল হলো আমার। অবশেষে আবার শীত পড়তে লাগলো, অফিসের সামনে থেকেই একজন সি.এন.জি ড্রাইভার কে জিজ্ঞেস করলাম, সে রেল ষ্টেশন যাবে নাকি, কিন্তু সে জানালো, এখান দিয়ে শমশের নগর রেল ষ্টেশন কাছে হবে, যেখান থেকে আমি আমার রিটার্ন টিকেট ব্যবহার করে উপবন এক্সপ্রেস ৭৪০ ট্রেনটি ধরতে পারবো। আমি তাতেই রাজি হলাম, এবং সেই সি.এন.জি তে করে চলে আসলাম শমশের নগর রেল ষ্টেশন।


রেল ষ্টেশনে এসেও অনেক বার তাকে ফোনে ট্রাই করলাম লাভ হলোনা, অবশেষে দূরে এক জায়গায় নজর পড়লো রেললাইনের পাশে যেখানে কিছু মানুষ আগুন পোহাচ্ছে। আমি সেখানে গেলাম তাদের সাথে যোগ দিলাম। যখন আগুনের জন্য কাঠ কাগজ প্রয়োজন হলো, তখন আমি আমার কাধের ব্যাগ ছুড়ে দিলাম জলন্ত আগুনের মাঝে।

এই ব্যাগের মধ্যে ছিলো, আমার প্রথম গাড়িতে হেল্পারির কাজ করে উপার্জন করা প্রথম টাকার একটি একশো টাকার নোট, ২০০৯ সালের একটি ডায়রী যাতে লেখা ছিলো, আমার সব হাসি কান্নার কথা, স্বপ্নগুলোর কথা। ছিলো ২০১১ এর ভালোবাসার দিবসে স্বপ্ন প্রেয়সীর জন্য কেনা এক ছড়া গোলাপ। যা এখন শুকিয়েছে মরেছে, লাল রংয়ের পরিবর্তে হয়েছে কালো কুচকুচে রঙ তবুও সেগুলো আমার কাছে নতুনের মতই সতেজ। কারন সময় দিয়ে নয় আমি ভালোবাসা দিয়ে গোলাপগুলোকে এত গুলো বছর আগলে রেখেছিলাম।

সাথে ছিলো একটি কলম, একজন পাঠক আমাকে কুরিয়ার করে পাঠিয়েছিলেন আমার লেখায় মুগ্ধ হয়ে, ছিলো হাতের আংটি, আর নীল রংয়ের চুড়ি, সাথে ছিলো একটি শাড়ি, যা আমি এনেছিলাম মালয়েশিয়া থেকে। আর ছিলো শিখার দেওয়া ১৫০০ টাকা, এবং একটি মেমোরি কার্ড, যে কার্ডের মধ্যে ছিলো আমার লেখা ১৫ টি গানের রেকর্ড। আমার গান তো শিখার অনেক ভালো লাগতো তার জন্য তো এখন গিটার বাজানো শিখতেছি। হয়ত সেই গিটারের সুর তার কান পর্যন্ত পৌছাবে না কোনদিন।


এখন রাত ১১.৫৮ মিনিট আমি ৭৪০ নম্বর উপবন এক্সপ্রেস এর কোচ-ছ, সিট-০৩ বসে ঢাকা ফিরে যাচ্ছি আমার জমানো সারাজীবনের সমস্ত ভালোবাসা, স্বপ্ন আর চেষ্টাগুলোকে সিলেট মৌলভীবাজার এর মাটিতে পুড়িয়ে দিয়ে। বিদায় নিচ্ছি প্রিয় মৌলভী বাসিদের কাছ থেকে।
শিখা, তোমার দেওয়া ঋন এর দাবী কখনো ছাড়বে না, যদি রোজ হাশরে নেকীর অভাব পড়ে যেন এই ঋন এর দাবীদার হয়ে আমার নেকী গুলো নিয়ে জান্নাতবাসী হতে পারো। ভালো থেকো সুখেই থেকো।
তারপরের জীবন পাতায় আমার সাথে কি ঘটবে তা বেচে থাকলে এমনি কোন না কোন গল্পের তালে তালে সবাইকে জানাবো।
বিদায়, প্রিয় মৌলভীবাজার।

Post a Comment